রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:৩৫ পূর্বাহ্ন

এমডির অনিয়মে ডুবছে তাকাফুল : নেই ছাড়পত্র, ৫৫ শতাংশ কমিশনসহ করছেন বাকী ব্যবসা

এমডির অনিয়মে ডুবছে তাকাফুল : নেই ছাড়পত্র, ৫৫ শতাংশ কমিশনসহ করছেন বাকী ব্যবসা

বিশেষ প্রতিনিধি :

বীমা আইন লঙ্ঘন, ছাড়পত্র ছাড়া চাকরী, বাকি ব্যবসা, অতিরিক্ত কমিশন গ্রহণ, ডামি নিয়োগ দেখিয়ে অর্থ লোপাট- এমন অনেক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও কাজী মোকাররম দস্তগীর এর বিরুদ্ধে।

বীমা আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন পদে ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। অথচ, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী থেকে ২০২১ সালে ‘ছাড়পত্র’ ছাড়াই তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের সিইও হিসেবে যোগদান করেন কাজী মোকাররম দস্তগীর। বীমা আইন অনুযায়ী মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ বিধিমালায় ৩ বছর বাধ্যতামূলক করা হলেও তাকাফুলের পরিচালনা পর্ষদ মোকাররম দস্তগীরকে ২ বছরের জন্য অনুমতি চেয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়। সে সময় আইডিআরএ থেকে ৩ মাসের মধ্যে মোকাররম দস্তগীরকে ছাড়পত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আজও ছাড়পত্র জমা দিতে পারেননি তিনি। ছাড়পত্র ছাড়াই বরং পরবর্তীতে আরো এক বছরের জন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন জানায় তাকাফুলের পরিচালনা পর্ষদ। মোকাররম ইস্যুতে নিয়োগ নীতিমালার ৩ বছরের নিয়ম ভঙ্গ করে ‘তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স পরিচালনা পর্ষদ কিংবা আইডিআরএ’ বীমা আইন লঙ্ঘন করছেন কি না- এমন প্রশ্ন তুলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন প্রসঙ্গে ‘বীমা আইন এবং এর পরিপালন’ নিয়েও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে কিভাবে ‘ছাড়পত্র’ ছাড়া একজন এমডি দায়িত্ব পালন করছেন সেই প্রশ্ন উঠেছে।

দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘‘আর্থিক হিসেব সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কাজী মোকাররম দস্তগীরকে প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। ‘‘

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তির সিইও পদে যোগদান করা বীমা আইন ২০১০-এর ৮০ ধারা এবং বীমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২-এর পরিপন্থী। আইনে বলা হয়েছে, আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কেউ সিইও হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। বেতন-ভাতাও নিতে পারবেন না।

এদিকে সবশেষ, গত ৩০ এপ্রিল কাজী মুকাররম দস্তগীরের এক বৎসরের নিয়োগ আইডিআরএ অনুমোদন না-দেয়ায় মূলতঃ মুখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য হয়ে যায়। তারপরও তিনি দিব্যি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আইডিআরএকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে আইন অমান্য করার সাহস তিনি কোথায় পেলেন- তাঁর ক্ষমতার উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পদে ছাড়পত্রহীন‘ চাকরীর অবাধ সুযোগ এবং তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স এর পরিচালনা পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গে সখ্যতা- মোকাররম দস্তগীরকে বেপরোয়া করে তোলে। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনৈতিকতার আশ্রয় গ্রহণ করে বীমা আইন লঙ্ঘন করে শুরু করেন বাকী ব্যবসা। ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রাঞ্চ এবং শাখা অফিসগুলোতে ৫ কোটি টাকার বেশি বাকী ব্যবসা করে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, কাজী মোকাররম দস্তগীর যোগদানের পরই বাকী ব্যবসার মতো অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় এই সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠানটি। অন্যান্য কর্মকর্তারা বাকীতে ব্যবসা বন্ধর জন্য সিইওকে অনুরোধ জানালেও মোকাররম দস্তগীর তা কর্ণপাত করেননি। সারা দেশের বাকী প্রিমিয়ামের ৫ কোটি টাকা উঠে আসবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে।

নিয়োগপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাজী মোকাররম দস্তগীর মাসে ৩ লক্ষ টাকা শুধু বেতন বাবদ গ্রহণ করতে পারবেন। অথচ, যোগদানের পর বীমা আইন লঙ্ঘন করে বাকি ব্যবসা, অতিরিক্ত কমিশন এবং প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ অমান্য করে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যবসা করেছেন। অতিরিক্ত কমিশন কিংবা ডামি নিয়োগ– নানা অজুহাতে কোম্পানি থেকে অর্থ হাতিয়েছেন। বীমা আইন, আইডিআরএর প্রজ্ঞাপন কিংবা পরিচালনা পর্ষদের নিয়োগ বিধির শর্তভঙ্গ করে ৫৫ শতাংশ অবৈধ কমিশন তুলে নিচ্ছেন।
২০২৩ সালের মার্চ এবং এপ্রিল মাসেই অবৈধভাবে ৫৫ শতাংশ অতিরিক্ত কমিশন তুলে নিয়েছে কাজী মোকাররম। তাঁর এই আইন বর্হিবূত কর্মকান্ডে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হলে ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না।
প্রতিষ্ঠানটিতে এপ্রিল মাসেই তার নিয়ন্ত্রিত শাখায় বিভিন্ন নামে কমিশনের হিসাবে ৫৫ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

অতিরিক্ত কমিশন, বাকী ব্যবসা এবং বিভিন্ন অনিয়ম সর্ম্পকে জানতে চাইলে কাজী মোকাররম দাস্তগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতিরিক্ত কমিশন দেশের বীমা খাতকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে অনেকগুলো বীমা কোম্পানীর কারণে এক ধরণের অসুস্থ প্রতিযোগীতা কাজ করে। এছাড়াও মালিকদের লোভ, কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনৈতিকতা, আইনের বাস্তবায়ন না-থাকা অতিরিক্ত কমিশনের জন্য দায়ী। তবে তাকাফুল সে অসুস্থ প্রতিযোগীতার শিকার।

ছাড়পত্র ছাড়া কিভাবে চাকরী করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী মোকাররম দস্তগীর বলেন, ‘‘এটা আমার কোন বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠানের বোর্ড এবং আইডিআরএ দেখবে। এখানে আমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই।’’

এছাড়াও তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘‘পেশাগত যায়গায় এসব জটিলতা ভালো লাগে না। আমি চাকরী ছেড়ে দিবো। পাসর্পোট রেডি, দেশের বাইরে চলে যাবো।’

বীমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের কারণে তাকাফুলের ভবিষৎ অবস্থা দিন দিন নিম্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাজী মোকাররম দস্তগীর ৩ বছর চাকুরীরত অবস্থায় অসংখ্যবার বীমা আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলেছেন। সবশেষ কোম্পানীর সিদ্ধান্তের বিপরীতে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টি সামনে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন পরিচালনা পর্ষদ। তাঁর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি-সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা অভিযোগ তীব্র হলেও- এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আইনগত কোন বৈধতা না থাকার সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানান অপ-কৌশল গ্রহণ করেছেন সিইও। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে স্থায়ীভাবে বরখাস্তর পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত।

 

এ প্রসঙ্গে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স এর ভাইস চেয়ারম্যান এমদাদ উল হক বলেন, ‘‘এমডি নিয়োগ, অতিরিক্ত কমিশন, বাকী ব্যবসা, এসব বিষয়ে কোন অভিযোগ আসলে আগামী মঙ্গলবার বোর্ড মিটিংএ আলোচনা হবে। কেউ অভিযুক্ত হলে তার বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তারপরেও এসব অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইসি কমিটির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির পাটোয়ারীকে ফোন করার জন্য বলেন তিনি। ”

পরবর্তিতে প্রতিষ্ঠানের ইসি কমিটির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী বলেন, ‘‘তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সে কোন অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে চেয়াম্যান এবং পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলুন।‘‘

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তাহমিনা আফরোজ এর বক্তব্য নিতে চাইলে তাকে মুঠো ফোনে পাওয়া যায়নি।

বিশেজ্ঞরা মনে করেন, মুখ্য নির্বাহী কোম্পানির মূল চালিকাশক্তি। সর্বোচ্চ এ পদে অনিয়ম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে আইনের যে বিধান রয়েছে তা পরিপালন না করাও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মো. মামুন হোসেন শামিম বলেন- ‘‘দেশ, দেশের অর্থনীতি, বীমা খাত, গ্রাহক এবং শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় পুজিঁবাজারে তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা আর্থিক অনিয়মে জড়িত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। অপরাধীর ঠিকানা হবে জেলখানা।’’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট মোহাম্মদ আবু সাইদ সিদ্দিকী টিপু বলেন, ‘‘বীমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। কিন্তু এ খাত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা নেতিবাচক। গুটিকয়েক মানুষের প্রতারণা, আত্মসাতসহ নানা অনিয়মের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন এই খাতটিতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এ বিষয়ে আইডিআরএকে আরো বেশি কঠোর ভুমিকা পালন করতে হবে। অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ, সংক্ষুদ্ধ কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের আইনী সাহায্য দরকার হলে, বীমা খাতের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে আমরা ‘ফ্রি আইনী সহায়তা’প্রদান করবো।’

এ প্রসঙ্গে আইডিআরএ’র একজন সদস্য বলেন, বীমা কোম্পানির নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্যা, অতিরিক্ত কমিশন, বাকী ব্যবসা ও অন্যান্য অনিয়ম খুঁজে বের করতে প্রয়োজনে বিশেষ অডিটের সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। অনিয়ম প্রমান হলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

প্রিয় পাঠক, আমাদের অনুসন্ধান এবং একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, আর জাল-জালিয়াতির তথ্য উঠে এসেছে। তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড-এ চাকুরীরত থাকা অবস্থায় ৩ বছর তিনি অনেক ক্ষেত্রে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’র নির্দেশনা, প্রজ্ঞাপন ও বীমা আইন লঙ্ঘন করে যেভাবে বীমা খাতকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বির্তকিত ও ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন, একইসঙ্গে নিজে শাস্তিযোগ্য অপরাধে জড়িয়েছেন- সেই তথ্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হবে পাঠকদের সামনে। থাকবে তার দূর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম নিয়ে একাধিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন। চোখ রাখুন- পরবর্তী নিউজের জন্য। থাকুন আমাদের সঙ্গে।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com